বাংলা চলচ্চিত্রে যাদের অবদান কখনই ভোলার নয়, তাদের মধ্যে প্রথম সারিতে থাকবেন খান আতাউর রহমান। যিনি খান আতা নামে বহুল পরিচিত। তিনি ছিলেন একাধারে চলচ্চিত্র অভিনেতা, গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক, গায়ক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, কাহিনিকার এবং প্রযোজক। চলচ্চিত্রের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তার ছোঁয়া নেই। চলচ্চিত্রে এখন যে অমানিশা চলছে সেখানে খুবই প্রয়োজন খান আতার মতো একজন মানুষ। তা না হলে মৃতপ্রায় চলচ্চিত্রকে বাঁচানো খুবই কঠিন। কিন্তু খান আতা তো যুগে যুগে একজনই হয়। এই দুঃসময়ে তার মতো সব্যসাচী নির্মাতার বড্ড প্রয়োজন। আজ এই কিংবদন্তির মৃত্যুবার্ষিকী…
ব্যক্তিগত জীবন
চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব খান আতাউর রহমান তিনবার বিয়ে করেন। তার প্রথম স্ত্রী শার্লি। লন্ডন থাকাকালীন ১৯৫৮ সালে তিনি তাকে বিয়ে করেন। পরে বাংলাদেশে আসার পর ১৯৬০ সালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। শার্লি তার সন্তানকে নিয়ে লন্ডন চলে যান। পরে ১৯৬০ সালে তিনি কণ্ঠশিল্পী মাহবুবা রহমানকে বিয়ে করেন। তার তৃতীয় স্ত্রী নীলুফার ইয়াসমীন। ১৯৬৮ সালে তিনি তাকে বিয়ে করেন। খান আতা ও মাহবুবা রহমানের ঘরে জন্ম নেন কণ্ঠশিল্পী রুমানা ইসলাম। অপরদিকে খান আতা ও নিলুফারের ঘরে জন্ম নেন বর্তমান প্রজন্মের গায়ক আগুন।
অভিনয় জীবন
খান আতা ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানি পরিচালক আখতার জং কারদার পরিচালিত উর্দু ভাষার চলচ্চিত্র জাগো হুয়া সাভেরাতে মূল ভূমিকাতে অভিনয়ের মাধ্যমে তার চলচ্চিত্র জীবন শুরু করেন। এতে তার বিপরীতে ছিলেন ভারতীয় অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্র। এ ছায়াছবির সহকারী পরিচালক ছিলেন জহির রায়হান। চলচ্চিত্র জগতে তিনি আনিস নামটি ব্যবহার করতেন। একই বছরে মুক্তি পায় তার অভিনীত প্রথম বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র ‘এ দেশ তোমার আমার’। এই চলচ্চিত্রের পরিচালক ছিলেন এহতেশাম। ১৯৬০ সালে জহির রায়হানের সঙ্গে গড়ে তোলেন লিটল সিনে সার্কেল। এতে পরের বছরগুলোতে তার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। অভিনেতা হিসেবে তিনি কাজ করেছেন কখনো আসেনি, যে নদী মরুপথে, সোনার কাজল, জীবন থেকে নেয়া, সুজন সখীর মতো সফল চলচ্চিত্রে।
সংগীত জীবন
খান আতা সংগীত পরিচালক হিসেবে প্রথম কাজ করেন এহতেশাম পরিচালিত এ দেশ তোমার আমার চলচ্চিত্রে। পরে ১৯৬২ সালে সূর্যস্নান ছায়াছবিতে তিনি উপহার দেন পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া রে-এর মতো গান। যাতে কণ্ঠ দেন কলিম শরাফী। ১৯৬৩ সালে জহির রায়হানের কাঁচের দেয়াল ছায়াছবিতে তিনি নিয়ে আসেন শ্যামল বরণ মেয়েটি শীর্ষক একটি জনপ্রিয় গান। সূর্যস্নান ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে এবং কাঁচের দেয়াল ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক হিসেবে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসবে তিনি পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া সংগীত পরিচালক ছিলেন বাহানা, সাগর, আখেরি স্টেশান, মালা প্রভৃতি উর্দু ছবিতে। ১৯৭০ সালে জহির রায়হান পরিচালিত জীবন থেকে নেয়াতে তিনি এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে শীর্ষক গানের কথা লেখেন এবং নিজেই কণ্ঠ দেন, ’৭০ এবং ’৮০-র দশকে উপহার দেন সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠে এ কি সোনার আলোয়, শাহনাজ রহমতুল্লাহের কণ্ঠে এক নদী রক্ত পেরিয়ে-এর মতো গান। খান আতাউর রহমান প্রায় ৫০০ গানের গীতিকার। এখনো অনেক রাত চলচ্চিত্রের জন্য তিনি ২২তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ গীতিকারের পুরস্কার অর্জন করেন।
চলচ্চিত্র পরিচালনা
তার প্রথম পরিচালিত চলচ্চিত্র অনেক দিনের চেনা। ছায়াছবিটি ১৯৬৩ সালে মুক্তি পায়। ১৯৬৭ সালে তিনি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার জীবনী নিয়ে নির্মাণ করেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। চলচ্চিত্রটি ১৯৬৯ সালে মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে গোল্ডেন প্রাইজের জন্য মনোনীত হয়। এর পর তিনি নির্মাণ করেন সাত ভাই চম্পা, অরুণ বরুণ কিরণমালা, জোয়ার ভাটা। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে নির্মাণ করেন আবার তোরা মানুষ হ; যার বিষয়বস্তু ছিল যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতা। ১৯৭৫ সালে প্রমোদ কর ছদ্মনামে গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মাণ করেন রোমান্টিক চলচ্চিত্র সুজন সখী। এই চলচ্চিত্রের জন্য তিনি ১ম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হিসেবে পুরস্কৃত হন। ’৮০-র দশকে নির্মাণ করেন হিসাব-নিকাশ এবং পরশপাথর নামের দুটি ছবি। মুক্তিযুদ্ধের ওপর ১৯৯৪ সালে তিনি এখনো অনেক রাত চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ শুরু করেন। ১৯৯৭ সালে ছবির কাজ শেষ হয়। একই সালের ১ ডিসেম্বর তিনি না ফেরার দেশে চলে যান।
Leave a Reply